কুরআনের সঙ্গেপূর্বসূরীদেরসম্পর্ক
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উম্মতের ওপর নিয়ামতের শেষ নাই। কত প্রকারের কত ধরনের নিয়ামতই না তিনি দান করেছেন। কোনো মানুষের পক্ষে এক বৈঠকে বা অনেকগুলো আসরে এসবের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা সাধারণভাবে মানবতার ওপর এবং বিশেষভাবে এই উম্মতের ওপর সবচে বড় যে নেয়ামতটি দান করেছেন তা হলো কুরআন নাযিলকরণ। আল্লাহ তা‘আলা যাকে সমগ্র মানবতার জন্য নিয়াতম হিসেবে দান করেছেনসেই মহাগ্রন্থ অবতরণ করা। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা এ কিতাবকে আসমানী কিতাবসমূহের পরিসমাপ্তি হিসেবে নাযিল করেছেন। এটিকে নিখিল সৃষ্টির জন্য প্রমাণ বানিয়েছেন। এটি তাই সকল নবীর নিদর্শনের শ্রেষ্ঠতম। নবীরা যত কিতাব এনেছেন তার মহানতম। এ মহা গ্রন্থ এমনএকমু‘জিজা, মহা নিদর্শন ও শ্বাশত নমুনা- যার প্রভাব কোনো যুগ বা স্থানে সীমিত নয়। বরং যতকাল দিন-রাতের গমনাগমন অব্যাহত থাকবে এটিও ততদিন সমুজ্জ্বল থাকবে। এমনকি যখন মানুষ আর কুরআনকে গ্রহণ করবে না, এ কিতাবের প্রতি আগ্রহ থেকে তাদের অন্তর সরে যাবে এবং এ থেকে উপকৃত হওয়ার প্রবণতা বাতিল হয়ে যাবে, তখন শেষ যামানায় মানুষ এ থেকে উপকৃত না হলে আল্লাহ তা‘আলা একে উঠিয়ে নেবেন। কারণ কুরআনকে কিতাবের পৃষ্ঠা ও মানুষের অন্তর থেকে তুলে নেওয়াই হবে তখনএর মর্যাদারক্ষার দাবী।
আল্লাহ তা‘আলা এ প্রজ্ঞাময় গ্রন্থ অবতরণের সুসংবাদ দিয়েছেন। সাধারণভাবে মানবজাতির ওপর এ কিতাব নাযিলের সুসংবাদ দিয়েছেন খোদ আল্লাহ সুবহানুহু ওয়াতা‘আলা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧﴾ [يونس: 57]
‘হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত।’{সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৭}
এ সুসংবাদ ও বয়ানের পর আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় বলছেন,
﴿قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ٥٨﴾ [يونس :58]
‘বল, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়’। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম।’{সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৭}
এ সুসংবাদ লাভ করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন আনন্দের সঙ্গে। কিতাবুল্লাহ লাভের আনন্দ ছিল মূলত আল্লাহর নেয়ামত লাভেরই আনন্দ। আল্লাহ যে তাঁকে বিশেষ এ মহা অনুগ্রহ দান করেছিলেন আনন্দটি ছিল তারই বহিপ্রকাশ। এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরাও আমোদিত হয়েছিলেন। কারণ কিতাব ছিল তাঁদের ওপর সবচে বড় নেয়ামত। পক্ষান্তরেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ নেয়ামত অবতরণের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটা ছিল তাদের জন্য সবচে বড় মুসীবত। কেননা এর মাধ্যমে মূলত আসমানী সাহায্যের ধারা বন্ধ হয়ে যায়। এই কল্যাণ এবং এই কিতাবের ধারা বন্ধ হয়ে যায়। যা নিয়ে আহ্লাদিত হয়েছিলেন তাবেয়ীগণ এবং আহ্লাদিত হয়েছেন ও হবেন কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁদেরকে সুন্দরভাবে অনুসরণকারীগণ। যখন তারা এ থেকে মহান গুণাবলিতে ঋব্ধহবেন, যা মানুষের উভয় জগতের সাফল্য- দুনিয়ার সফলতা ও আখিরাতের কামিয়াবীর গ্যারান্টি দেয়। কেননা এ কিতাবের উপকারিতা শুধু সুস্থিরতার জগত তথা আখিরাত জগতেইসীমাবদ্ধ নয়, বরং আখিরাতের আগে দুনিয়ার জীবনেও মুমিন এর সুফল পাবে। অতএব তা এমন কিতাব যার মাধ্যমে মানুষের সবকিছু সংশোধিত হয়। এর দ্বারা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় অবস্থা সুসংহত হয়। এ জন্যই আল্লাহ সাধারণভাবে সব মানুষকে এরসুসংবাদ দিয়েছেন। এটি হেদায়েত, রহমত ও শিফা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿وَنُنَزِّلُ مِنَ ٱلۡقُرۡءَانِ مَا هُوَ شِفَآءٞ وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ﴾[الاسراء :82]
‘আর আমি কুরআন নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত।’{সূরা আল-ইসরা, আয়াত : ৮২}এখানে মুমিনদের খাস করা হয়েছে এজন্য যে সাধারণত তারাই এ কুরআন থেকে উপকৃত হয়। নয়তো কুরআন প্রত্যেকের জন্যই রহমত স্বরূপ। অতএব এতে রয়েছে হিদায়াত ওনূর। এতে আছে মানব জীবনেরযাবতীয় অনুষঙ্গের সুবিন্যাস, তাদের পরকালের সুপ্রতিষ্ঠা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ।এ জন্যই এ কিতাব এমন অনেক ব্যক্তির জ্ঞানকেও নাড়া দেয় যারা আজ অবধি ঈমান আনে নি। কারণ এর মধ্যে এমন বর্ণনা, এমন অলৌকিকত্ব এবং এমন গূঢ় রহস্য রয়েছে যাকে কোনো জ্ঞান পরিবেষ্টন করতে পারে না। কোনো অভিব্যক্তি তাকে প্রকাশ করতে পারে না। কোনো ভাষা যার বিবরণ দিয়ে শেষ করতে পারে না। এমন বিষয় যা বর্ণনাতীত। এমন যা কল্পনাতীত। কেনই বা নয়,এটি তো নিখিল জগতের রবের কালাম। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রজ্ঞাময় বাণীতে বলেন,
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١﴾ [الشورى :11]
‘তার অনুরূপ কেউ নেই এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ {সূরা আশ-শূরা, আয়াত : ১১} অতএব আমাদের রবের মতো কেউ নেই। না তাঁর গুণাবলিতে, না তাঁর সত্তায় আর না তাঁর কার্যাবলিতে। তাঁর জন্য যা ওয়াজিব তাতেও নয়। আল্লাহ তা‘আলা নিজের সম্পর্কেযা কিছু বিবরণ দিয়েছেন তার অন্যতম একালাম। অতএব আমাদের মহান রবের কালামের অনুরূপ কোনো কালাম নেই। যেমন তাঁর মহান গুণাবলির অনুরূপ গুণাবলি নাই। একইভাবে আল্লাহ জাল্লা শানুহূ সংশ্লিষ্ট সবকিছুরই কোনো নজির বা উপমা নেই।
পূর্বে যেমন আমি বলেছি এ গ্রন্থটি পেয়ে সালাফগণ মহা উৎফুল্ল হয়েছেন। এত অনুরাগ ও আবেগে তারা আপ্লুত হয়েছেন যে এর তিলাওয়াতকিংবা অধ্যয়নে তারা পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি। তাই তাঁদের অবস্থাদিতে, তাঁদের বিষয়াশয়ে ওতাঁদের সম্পর্কেযা উদ্ধৃত হয়েছে এবং সীরাত গ্রন্থগুলো তাঁদের কার্যাদির যা তুলে ধরেছে, তা থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি এ মহান কিতাব নিয়ে তাঁদের আনন্দের সীমা ছিল না। এ বিষয়ে তাঁদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। তাঁদের হৃদয়ে সম্মানের সবটুকু জুড়ে ছিল এ মহাগ্রন্থ।
এখানে সালাফে সালেহ বলে প্রথমত বুঝানো হচ্ছে সাহাবায়ে কিরামকে। তাঁরাই এর অবতরণ প্রত্যক্ষ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাঁরাই সরাসরি এ কিতাবের পাঠ নিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকেই তাঁর রাসূলের সহচর হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হিসেবে তাঁরাই ছিলেন বিশেষায়িত। হ্যা, এঁরাই হলেন প্রথম স্তরের সালাফ। মর্যাদার দিক দিয়ে তাঁদের অব্যবহিত পরেই অবস্থান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের এ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। যেমন :
عَنْ عَبْدِ اللهِ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَال: «خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي ثمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ».
আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ হলো আমার যুগের লোকেরা। অতপর যারা তাদের অব্যবহিত পরেআসবে এরপর যারা তাদেরপরেআসবে। [বুখারী : ৬৫১; মুসলিম : ২৫৩৫]
সুতরাং তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীরাও সালাফে সালেহের অন্তর্ভুক্ত। কারণ তারাও তাঁদের মধ্যে শামিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের সকল যুগের ওপর যাদের শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত করেছেন। এ আর উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব কোনো স্থান বা কালের মধ্যে সীমিত নয়। বরং চিরকাল তার অবকাশ থাকবে। কেননা আল্লাহ জাল্লা শানুহূ মুহাজির ও আনসারীগণের উত্তম অনুসারীদের জন্যও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহূ ইরশাদ করেন,
﴿وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ وَأَعَدَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي تَحۡتَهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١٠٠﴾ [التوبة :100]
‘আরমুহাজিরওআনসারদেরমধ্যেযারাপ্রথমওঅগ্রগামীএবংযারাতাদেরকেঅনুসরণকরেছেসুন্দরভাবে, আল্লাহতাদেরপ্রতিসন্তুষ্টহয়েছেনআরতারাওআল্লাহরপ্রতিসন্তুষ্টহয়েছে।আরতিনিতাদেরজন্যপ্রস্তুতকরেছেনজান্নাতসমূহ, যারতলদেশেনদীপ্রবাহিত, তারাসেখানেচিরস্থায়ীহবে।এটাইমহাসাফল্য।’{সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ১০০}
তাই উম্মতের সালাফের অনুসরণ-অনুবর্তন আমাদের অন্তর্ভুক্ত করবে তাঁদের সূতোয়, আমাদের মিলিত করবে তাঁদের দলে। যদিও আমরা তাঁদের যুগে তাঁদের সঙ্গী না হতে পারি। যদিও আমাদের অবস্থান হয় তাঁদের চেয়ে অনেক দূরে। বরং আমরাও তাঁদের ফযীলত ও মর্যাদায় শামিল হতে পারি যদি আমরা তাঁদের আমাল ও আখলাকে শরীক হই।
নিশ্চয় এ কুরআন যেমন আল্লাহ জাল্লা শানুহূ বলেছেন- বর্ণনা হিসেবে তাঁর বর্ণনাই যথেষ্ট আর বিবরণ হিসেবে তাঁর বিবরণই যথার্থ- কেন নয়, তিনি তো মহা প্রজ্ঞাবান, সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞাতা। তাঁর কাছে কোনো গোপনই গোপন নয়। আর তাঁর কিতাবের বিবরণ প্রদানে সমগ্র সৃষ্টিকখনো তাঁর ধারে কাছেও পৌঁছতে পারবে না, যতই তারা জ্ঞানী হোক। তারা যত জনই একত্রিত হোক। নিজের কিতাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ জাল্লা শানুহূ বলেন,
قٓۚ وَٱلۡقُرۡءَانِ ٱلۡمَجِيدِ ١[ق :01]
‘কাফ; মর্যাদাপূর্ণকুরআনেরকসম।’ {সূরা কাফ, আয়াত : ০১}আল্লাহ সুবহানুহূ ওয়াতা‘আলা এখানে ‘মাজদ’ বা মর্যাদা শব্দব্যক্ত করেছেন। আরবদের ভাষায় ‘মাজদ’ শব্দটি গুণাবলির পূর্ণতার ব্যাপ্তি ও সুবিস্তৃতিবুঝায়। তাই যা-ই তার গুণাবলির পূর্ণতায় ব্যাপকতা ধারণ করে তার জন্যই এ বিশেষণটি প্রয়োগ করা হয়। তার বেলায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অতএব ‘মাজীদ’ অর্থ সেই জিনিস যা বিশেষণে পূর্ণ, যার মর্যাদা ওশ্রেষ্ঠত্বের গুণের ব্যপ্তি অন্তহীন। এমনকি তা সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত এবং অভীষ্ঠ মর্যাদায় স্থিত। কেন নয়, এটিতো রূহ। কেন নয়, এটি তো নূর। কেন নয়, এটি তো হিদায়াত। কেন নয়, এটি তো আত্মিক রোগের শিফা। আল্লাহ জাল্লা ওয়া আলা যেমন বলেন,
﴿وَنُنَزِّلُ مِنَ ٱلۡقُرۡءَانِ مَا هُوَ شِفَآءٞ وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ﴾ [الاسراء :82]
‘আর আমি কুরআন নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত।’{সূরা আল-ইসরা, আয়াত : ৮২} আল্লাহ সুবহানুহূর বাণী﴿مِنَ ٱلۡقُرۡءَانِ ﴾ শব্দ এখানে ‘তাবঈ’য’ বা ‘কিছু’ অর্থবোধক নয়। বরং তা এখানে ‘জিনস’ বা সমগ্রতাকে বুঝানোর জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ সমগ্র কুরআনই মানুষের অন্তরের জন্য শিফা স্বরূপ। এটি যেমন ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য রোগের আরোগ্যের কারণ, তেমনি তা বস্তুত, মৌলিকভাবে ও প্রধানত আত্মার ব্যধিসমূহ থেকে, সংশয় ও প্রবৃত্তির বিবিধ রোগ থেকে আরোগ্য দান করে।
উম্মতের পূর্বসূরীরা এ কুরআনের প্রতি ছিলেন তীব্র মনোযোগী। তাঁদের এক ঝলক ঘটনাই আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দেবে কুরআনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা কত চমৎকার ছিল। এতে অবশ্য বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ পূর্বসূরীদের যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি লক্ষ করে আমাদের ললাট কুঞ্চিত হয়, তাঁদের যে অগ্রসরতা দেখে আমাদের নেত্রদ্বয়বিস্ফোরিত হয়, তা এ জন্য যে তাঁরা সেই মর্যাদায় উন্নীত হয়েছিলেন এবং সেই স্তরে পৌঁছেছিলেন-যেখানে তাঁরা আল্লাহ জাল্লা ওয়াআ‘লার বাণী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনাকে পরিপূর্ণভাবে চিত্রিত করেছিলেন। তাই এ উম্মতই শ্রেষ্ঠ উম্মত যাদেরকে বের করা হয়েছে মানুষের মঙ্গলের জন্য। তাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মুসহাফে কারীমের উভয় পাশ থেকে, এই প্রজ্ঞাময় কুরআনের সামনে থেকে।পাঠানো হয়েছে এই কুরআন এবং এর সুস্পষ্ট এ আয়াতগুলোর নির্দেশনার আলোকে। এই উম্মতসম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে- যাতে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হন সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুম- আল্লাহ জাল্লা ওয়াআ‘লা বলেন,
﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ وَلَوۡ ءَامَنَ أَهۡلُ ٱلۡكِتَٰبِ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۚ مِّنۡهُمُ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَأَكۡثَرُهُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ١١٠﴾ [آل عمران : 110]
‘তোমরাহলেসর্বোত্তমউম্মত, যাদেরকেমানুষেরজন্যবেরকরাহয়েছে।তোমরাভালকাজেরআদেশদেবেএবংমন্দকাজথেকেবারণকরবে, আরআল্লাহরপ্রতিঈমানআনবে।আরযদিআহলেকিতাবঈমানআনত, তবেঅবশ্যইতাতাদেরজন্যকল্যাণকরহত।তাদেরকতকঈমানদার।আরতাদেরঅধিকাংশইফাসিক।’ {সূরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১১০}
এ উম্মতকে এ জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বৈশিষ্ট্য ও কুরআনের এ পন্থায়ইএদের বের করা হয়েছে। এর পরে আর সীরাত ও হাদীসগুলো এবং গ্রন্থ ও কিতাবগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গীবৃন্দ ও তাঁদের অনুসারী তাবেয়ী ওতাবে তাবেয়ীদের কুরআন মাজীদ কেন্দ্রিক উপহার দেয়া বিস্ময়কর ঘটনায় অবাক হবার কিছু নেই।
কুরআন আযীমের সঙ্গে সাহাবীদের আচরণ ও তাঁদের সজীবঅনুবর্তন সংক্রান্ত সীরাতের বিবরণের এক ঝলক অধ্যয়নও মানুষকে অভিভূত ও বিস্মিত না করে পারে না। যেমন আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে সহীহ বুখারী ও মুসলিমেবর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আল্লাহ জাল্লা শানুহূ নাযিল করলেন,
﴿لِّلَّهِ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ وَإِن تُبۡدُواْ مَا فِيٓ أَنفُسِكُمۡ أَوۡ تُخۡفُوهُ يُحَاسِبۡكُم بِهِ ٱللَّهُۖ فَيَغۡفِرُ لِمَن يَشَآءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَآءُۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ٢٨٤﴾[البقرة : 184]
‘আল্লাহরজন্যইযারয়েছেআসমানসমূহেএবংযারয়েছেযমীনে।আরতোমরাযদিপ্রকাশকরযাতোমাদেরঅন্তরেরয়েছেঅথবাগোপনকর, আল্লাহসেবিষয়েতোমাদেরহিসাবনেবেন।অতঃপরতিনিযাকেচানক্ষমাকরবেন, আরযাকেচানআযাবদেবেন।আরআল্লাহসবকিছুরউপরক্ষমতাবান।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৪}
এ আয়াতটি আমাদের অনেকেরই মুখস্থ। আমরা অনেকেই এ আয়াত পড়ে থাকি। কিন্তু আমরা অধিকাংশই এখানে এসে থমকে দাঁড়াই না। কারণ,আমরা কুরআনের অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের মন নিয়ে একে তিলাওয়াত করি না। বরং এর শব্দগুলো পাঠ করে তা থেকে নেকী অর্জনের অভিপ্রায়েআমরা কুরআন তিলাওয়াত করি। এর মর্ম উপলব্ধির তাড়নায়আমরা একে অধ্যয়ন করি না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যখন আল্লাহ জাল্লা শানুহূ এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন, যাতে যাবতীয় মালিকানা আল্লাহর, আসমান ও যমীনের যাবতীয় কর্তৃত্ব মহান রবের এবং তিনি মানুষের অন্তরের কল্পনা ও হৃদয়ের অব্যক্ত কথারও হিসেব নেবেন- যদিও তা উচ্চারণ না করা হয় এবং কর্মে প্রতিফলিত না হয়- যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ এ আয়াত শুনলেন, তাঁদের জন্য বিষয়টি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল। তাঁরা সবাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরর কাছে ছুটে এলেন। যেমন সহীহাইনে বিবরণ দেয়া হয়েছে :অতপর তাঁরা এ আয়াতের বক্তব্যের ভারে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, (ইতোপূর্বে) এমনসব আমল অর্পিত হয়েছে আমরা যার সামর্থ্য রাখি : সালাত, সিয়াম, জিহাদ, সাদাকা- অর্থাৎ এসবই আমরা করতে পারি। কিন্তু আজ আমাদের ওপর এমন এক আয়াত নাযিল হলো যার সামর্থ্য আমরা রাখি না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে শিষ্টাচার শিখিয়ে, কুরআনকে কীভাবে গ্রহণ করতে, নিখিল জাহানের রবের কালামকে কীভাবে হৃদয়াঙ্গম করতে হবে তা শিক্ষা দিয়ে তাঁদের উদ্দেশে বললেন,
« أَتُرِيدُونَ أَنْ تَقُولُوا كَمَا قَالَ أَهْلُ الْكِتَابَيْنِ مِنْ قَبْلِكُمْ سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا بَلْ قُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ ».
‘তোমরা কি চাইছো তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব দুই সম্প্রদায়ের মতো বলতে ‘আমরা শুনলাম এবং অমান্য করলাম’? তোমরা বল, আমরাশুনলামএবংমানলাম।হেআমাদেররব! আমরাআপনারইক্ষমাপ্রার্থনাকরি, আরআপনারদিকেইপ্রত্যাবর্তনস্থল।’ [মুসলিম : ১৭৯][1]তখন তাঁদের মধ্যে রাদিআল্লাহু আনহুম কেউই বাদ রইলেন না।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ সবাইমাথা পেতে নিলেন এবং বলে উঠলেন, ‘আমরাশুনলামএবংমানলাম।হেআমাদেররব! আমরাআপনারইক্ষমাপ্রার্থনাকরি, আরআপনারদিকেইপ্রত্যাবর্তনস্থল।’ উপস্থিত সবাই যখন এটি পড়লেন, বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁদের জিহ্বা এর অনুসরণ করল, বাক্যটি তাঁরা উচ্চারণ করলেন, পড়লেন এবং একে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করলেন, তখন রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে ছাড় ঘোষিত হল। আল্লাহ জাল্লা ওয়াআ‘লারপক্ষ থেকে অবকাশ ঘোষিত হল, যিনি বলেছেন,
﴿مَّا يَفۡعَلُ ٱللَّهُ بِعَذَابِكُمۡ إِن شَكَرۡتُمۡ وَءَامَنتُمۡۚ﴾[النساء : 147]
‘যদিতোমরাকৃতজ্ঞতাপ্রকাশকরএবংঈমানআনতাহলেতোমাদেরকেআযাবদিয়েআল্লাহকীকরবেন?’{সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১৪৭}
অর্থাৎ তোমাদেরওপর বোঝা চাপানোর মাধ্যমে তোমাদের আযাব দিয়ে আল্লাহর কী ফায়দা যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমান আন? তখন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এ উম্মতকেস্বস্তি প্রদান করা হল। আল্লাহর কিতাবে এ উম্মতের সাফাই নাযিল হল। রাসূলুল্লাহ বর্ণিত হলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করলেন,
﴿ءَامَنَ ٱلرَّسُولُ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡهِ مِن رَّبِّهِۦ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَۚ كُلٌّ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَمَلَٰٓئِكَتِهِۦ وَكُتُبِهِۦ وَرُسُلِهِۦ لَا نُفَرِّقُ بَيۡنَ أَحَدٖ مِّن رُّسُلِهِۦۚ وَقَالُواْ سَمِعۡنَا وَأَطَعۡنَاۖ غُفۡرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيۡكَ ٱلۡمَصِيرُ ٢٨٥ لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَعَلَيۡهَا مَا ٱكۡتَسَبَتۡۗ﴾[البقرة : 285-286]
‘রাসূলতারনিকটতাররবেরপক্ষথেকেনাযিলকৃতবিষয়েরপ্রতিঈমানএনেছে, আরমুমিনগণও।প্রত্যেকেঈমানএনেছেআল্লাহরউপর, তাঁরফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহওতাঁররাসূলগণেরউপর, আমরাতাঁররাসূলগণেরকারওমধ্যেতারতম্যকরিনা।আরতারাবলে, আমরাশুনলামএবংমানলাম।হেআমাদেররব! আমরাআপনারইক্ষমাপ্রার্থনাকরি, আরআপনারদিকেইপ্রত্যাবর্তনস্থল।আল্লাহকোনব্যক্তিকেতারসামর্থ্যরেবাইরেদায়িত্বদেননা।সেযাঅর্জনকরেতাতারজন্যইএবংসেযাকামাইকরেতাতারউপরইবর্তাবে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৮৫-২৮৬}
আমরা দেখলাম, এখানে রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে ছাড় এলো তাঁদের ঈমান প্রমাণিত হবার পর। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে আনীত বিষয় তাঁরা কবুল করার পর। হাদীসে উল্লেখিত এ ঘটনা প্রমাণ করে, সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুম কুরআনকে এমন কোনো বস্তু হিসেবে গ্রহণ বাকবুল করতেন না যা শুধু তিলাওয়াত করা হয়, যা থেকে বিধি-বিধান উদ্ভাবন করা হয় আর তাতে নিহিত মর্মগুলোর পরিচয় জানা যায়। তাঁরা বরং এ কুরআন পড়তেন এ মনে করে যে তাঁদের সম্বোধন করেই এসব বলা হচ্ছে।এর মর্মগুলোয় তাঁদের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ জন্যই বিষয়টি তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাই তাঁরা এ কুরআন ও মহা সংবাদের কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হতেন। হাদীসের কিতাবে বর্ণিত আল্লাহর বাণীতে কঠিন, জটিল ও কঠোর বিষয় পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সাহাবীদের ধর্ণা দেবার এটিই একমাত্র ও অদ্বিতীয় ঘটনা নয়। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, যখন আল্লাহ জাল্লা জালুহূ এ আয়াত নাযিল করলেন,
﴿ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يَلۡبِسُوٓاْ إِيمَٰنَهُم بِظُلۡمٍ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡأَمۡنُ وَهُم مُّهۡتَدُونَ ٨٢﴾ [الأنعام : 82]
‘যারাঈমানএনেছেএবংনিজঈমানকেযুলমেরসাথেসংমিশ্রণকরেনি, তাদেরজন্যইনিরাপত্তাএবংতারাইহিদায়াতপ্রাপ্ত।’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ৮২} [বুখারী : ৩১১০; মুসলিম : ১৭৮] এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে যারা তাঁদের ঈমানকে যুলম থেকে পবিত্র ও নিরাপদ রাখতে পেরেছেন তাঁদের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর বাণী﴿وَلَمۡ يَلۡبِسُوٓاْ إِيمَٰنَهُم بِظُلۡمٍ ﴾ অর্থ যারা তাঁদের ঈমানকে যুলমের সঙ্গে মেলায় নি।﴿أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡأَمۡنُ وَهُم مُّهۡتَدُونَ ﴾ তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের নিরাপত্তা এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁরাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। কেননা আহলে ঈমান তথা ঈমানওয়াদের জন্য প্রমাণিত ও কাঙ্ক্ষিত হিদায়াত শুধু দুনিয়াতেই সীমিত নয়। বরং হিদায়াত দুনিয়া ও আখিরাতে। আর আখিরাতের হিদায়াত দুনিয়ার হিদায়াতের চেয়ে বড়। তবে তা কেবল তারই থাকবে যার থাকবে দুনিয়ার হিদায়াত। কারণ আখিরাতের হিদায়াতের মাধ্যমেই সেই জটিল অবস্থানের বিভীষিকা থেকে পরিত্রাণ মিলবে যা যুবাদের পর্যন্ত বুড়ো বানিয়ে ছাড়বে। আল্লাহ তা‘আলা যেমনবলেছেন,
﴿وَتَرَى ٱلنَّاسَ سُكَٰرَىٰ وَمَا هُم بِسُكَٰرَىٰ وَلَٰكِنَّ عَذَابَ ٱللَّهِ شَدِيدٞ ٢﴾[الحج :02]
‘তুমিদেখবেমানুষকেমাতালসদৃশ, অথচতারামাতালনয়।তবেআল্লাহরআযাবইকঠিন।’ {সূরা আল-হাজ্জ : ০২}
ওই দিন মানুষ এমন হিদায়াতের মুখাপেক্ষী হবে যা দিয়ে তারা ওই বিভীষিকা থেকে বেরিয়ে আসবে, যা দিয়ে তারা ওই পা ফসকানো অবস্থান থেকে পরিত্রাণ পাবে, যা দিয়ে তারা পুলসিরাত পাড়ি দেবে। কারণ, আল্লাহ যদি তাকে পুলসিরাত পাড়ি দেবার হেদায়াত দান না করেন, তাহলে সে তা অতিক্রম করতে পারবে না। ওই পুল সে পাড়ি দিতে সক্ষম হবে না যার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তা চুলের চেয়ে সূক্ষ্ম এবং তরবারির চেয়ে ধারালো।
রাসূলুল্লাহর সাহাবীদের সামনে যখন আয়াতটি নাযিল হলো, তাঁরা তখন চিন্তান্বিত হয়ে রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে এলেন। তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে কে আছে যে কোনো যুলমে লিপ্ত হয় নি? আমাদের সবাই তো কম-বেশি যুলমে লিপ্ত হয়েছে। আর এ আয়াতের ভাষ্য মতে হিদায়াত ও নিরাপত্তার লাভের একমাত্র পাথেয়এমন ঈমান যার সঙ্গে মানুষ কোনো যুলমের স্পর্শ লাগায় নি। অতএব নিরাপত্তা ও হিদায়াতের শর্ত হলো মানুষের কোনো যুলমে লিপ্ত হওয়া চলবে না। সাহাবীরা এ থেকে বুঝলেন, এটি বুঝি সূক্ষ্ম, ছোট, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ওবড় তথা শিরক সবগুলোকেই অন্তর্ভুক্ত করবে। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে অনুযোগ করলেন,যুলম থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকা তো কারোপক্ষেই সম্ভব নয়। প্রতিটি মানুষই তো কম-বেশি যুলম করে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই যেমন বলেছেন,
« كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ »
‘প্রতিটি মানুষই ভুলকারী আর ভুলকারীদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাওবাকারী।’[তিরমিযী : ২৪২৩; আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ : ৩৫৩৫৭] এবং আল্লাহ তা‘আলাও যেমন এর আগে বলেছেন,
﴿وَحَمَلَهَا ٱلۡإِنسَٰنُۖ إِنَّهُۥ كَانَ ظَلُومٗا جَهُولٗا ٧٢﴾[الأحزاب :72]
‘আরমানুষতাবহনকরেছে।নিশ্চয়সেছিলঅতিশয়যালিম, একান্তইঅজ্ঞ।’{সূরা আল-আহযাব, আয়াত : ৭২} মানুষ তখনই এর প্রমাণ দিয়েছে যখন তারা কুরআনকে বহন করেছে অথচ আসমান, যমীন ও পাহাড়-পর্বতও তা বহনে সম্মত হয় নি। আল্লাহ যেমন ইরশাদ করেন,
﴿إِنَّا عَرَضۡنَا ٱلۡأَمَانَةَ عَلَى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱلۡجِبَالِ فَأَبَيۡنَ أَن يَحۡمِلۡنَهَا وأَشۡفَقۡنَ مِنۡهَا وَحَمَلَهَا ٱلۡإِنسَٰنُۖ إِنَّهُۥ كَانَ ظَلُومٗا جَهُولٗا ٢﴾[الأحزاب :72]
‘নিশ্চয়আমিআসমানসমূহ, যমীনওপর্বতমালারপ্রতিএআমানতপেশকরেছি, অতঃপরতারাতাবহনকরতেঅস্বীকারকরেছেএবংএতেভীতহয়েছে।আরমানুষতাবহনকরেছে।নিশ্চয়সেছিলঅতিশয়যালিম, একান্তইঅজ্ঞ।’{সূরা আল-আহযাব, আয়াত : ৭২}
আর এ গুণটি মানুষের কোনো ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা মানব জাতি বা মানব সম্প্রদায় নির্বিশেষের জন্য এ সম্বোধন। তাই তো তারা প্রত্যেকেই যুলমকারী বা জালেম, প্রত্যেকেই অজ্ঞ-বর্বর। কোনো মানুষই আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহ সুবহানুহূর পক্ষ থেকে রাসূলগণ যা এনেছেন তার হিদায়াত ছাড়া এ বিশেষণ দুটি থেকে মুক্ত থাকতে সক্ষম নয়।
সাহাবীগণ যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ আয়াতের বক্তব্যনিয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানাতে এলেন;তাঁদের কষ্টের কথা ব্যক্ত করতে এলেন,তিনি তাঁদের উদ্দেশে বললেন, বিষয়টি তোমরা যেমন ভাবছ তেমন নয়। অর্থাৎ তোমরা যা ধারণা করেছো যুলম বিষয়টি আয়াতে তেমন নয়। এটি বরং তা-ই লুকমান আলাইহিস সালাম তদীয় পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে যার ইঙ্গিত করেছেন :
﴿يَٰبُنَيَّ لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣﴾[لقمان :72]
‘প্রিয়বৎস, আল্লাহরসাথের্শিককরোনা; নিশ্চয়শিরকহলবড়যুলম’।{সূরা লুকমান, আয়াত : ১৩} অতএব আয়াতে যে যুলমের কথা বলা হয়েছে তা হলো শিরক। ব্যাস, বিষয়টি তখন সাহাবীদের জন্য সহজ হয়ে গেল।
কুরআনের সঙ্গে সাহাবীদের (রাদিআল্লাহু আনহুম) শীতল সম্পর্ক ছিল না। তাঁদের সম্পর্ক ছিল বরং আমলের সম্পর্ক। তাঁরা একে নিয়েছেন নিজেদের প্রতি সম্বোধন হিসেবে। ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,
إذا سمعت الله جل وعلا في كتابه يقول:﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ﴾فأرعها سمعك يعني أصغ إليها وأعطها أذنك فهي إما خير تؤمر به أو شر تنهى عنه"
‘তুমি যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে তাঁর কিতাবে বলতে শোন : ‘হে ঈমানদারগণ’তখন তোমার কর্ণকে সজাগ করো। অর্থাৎ সে দিকে মনোযোগ দাও, কানকে উৎকর্ণ কর। কারণ তা কোনো কল্যাণ হবে যার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে অথবা কোনো অকল্যাণ হবে যা থেকে তোমাকে বারণ করা হচ্ছে।’
এটি এ জন্য হয়েছে যে তাঁরা কুরআনকে মানার এবং আমলের জন্য বরণ করে নিয়েছেন। এতে যা সম্বোধন করা হয়েছে তা প্রত্যেক শ্রোতার উদ্দেশে, প্রত্যেকের জন্যই যার কাছে পৌঁছেছে। এর সম্বোধিতরা কোনো অতীত জাতি নয়। আমাদের জন্য শুধু এর ভেতর যা শব্দও কালাম রয়েছে তার আমল করা এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনই বাকি রয়েছে। সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুম এর উত্তম নমুনা প্রদর্শন করেছেন এবং তাঁরা আল্লাহর কিতাবের পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন।
এই দেখুন আবূ বকর রাদিআল্লাহু আনহুকে। তাঁর তনয়া আয়েশাকে যিনার অপবাদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ জাল্লা শানুহূ সূরা নূরের ‘ইফক’-এর ঘটনায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করেছেন। তাঁর নিষ্কলুষতার ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে দেখা গেল আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার প্রতি যারা অপবাদ আরোপ করেছিল, তাঁর শুভ্র চরিত্রে যারা মলিনতার ছাপ দিতে চেয়েছিল তাদের অন্যতম মিসতাহ বিন আছাছা। তিনি ছিলেন আবূ বকর রাদিআল্লাহুর নিকটভাজনদের একজন। অভাবী ছিলেন তিনি। আবূ বকর রাদিআল্লাহু আনহুতাঁকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন। অতপর যখন বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল। আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সপ্রমাণ হয়ে গেল। আবূ বকর রাদিআল্লাহু আনহু তখন শপথ করলেন এ দুষ্কর্মের পর তিনি আর তাঁকে সাহায্য করবেন না। আল্লাহ জাল্লা শানুহূ তখন নাযিল করলেন,
﴿أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ ﴾[النور :22]
‘তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেন?’ {সূরা আন-নূর, আয়াত : ২২} আবূ বকর রাদিআল্লাহু আনহু তখন বললেন, ঠিক আছে,ঠিক আছে। এরপর তিনি আয়েশারাদিআল্লাহু আনহার সঙ্গে বেয়াদবীমূলক আচরণ হেতুমিসতাহের প্রতি তাঁর দান-দাক্ষিণ্য বন্ধের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে এলেন।
কুরআনেরসঙ্গে সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুমের আচরণ শুধু একদিক থেকেবাএক দৃষ্টিকোণথেকে উন্নত ছিল না। নানা দিক থেকে তাঁরা কুরআনের সঙ্গে সম্পর্কে উম্মতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।এসবের মধ্যে রয়েছে তাঁদের কুরআন তিলাওয়াত। সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুম এ কুরআনের তিলাওয়াতকে নিজেদের জন্য অপরিহার্য করে নিয়েছিলেন। তাঁরা একে অপরকে পথে দেখা হলে কুরআন শিক্ষার নিয়তে বলতেন,আমাদের সঙ্গে বসুন আমরা কিছুক্ষণ ঈমান আনি। এ বলে একজন আরেকজনকে সূরা আসর পড়ে শোনাতেন। তাঁরা যখন একসঙ্গে হতেন যেমন তাঁদের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- একজন পড়তেন আর বাকিরা কুরআন শুনতেন। তাঁদের জীবন কুরআনের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের আত্মায়, ওঠাবসায়, আলোচনা ও উপদেশে মিশে গিয়েছিল কুরআন। প্রতিটি বিষয়ে কুরআন তাঁদের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। তাঁরা রাদিআল্লাহু আনহুম কুরআনের সঙ্গে একাত্ব হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা এতে মনোযোগ ও আগ্রহ নিবদ্ধ করেছিলেন। এ নিয়ে তাঁরা অন্য সব ব্যস্ততা রেখে ব্যস্ত হয়েছিলেন। এ জন্যই তাঁরা কুরআন অনুধাবনে তাঁরা অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমলে তাঁরা অন্যসবাইকেছাপিয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা জিহাদে। অন্যদের ছাপিয়ে গিয়েছিলেন আল্লাহ তাঁদের হাতে যেসব বিজয় রেখেছিলেন তাতে। এসবই ছিল কুরআনের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠা, একাগ্রতা, একাত্বতা ও অধিক পাঠের ফসল।
সাহাবীরা কুরআন তিলাওয়াত করতেন তাঁদের বৈঠকে, তিলাওয়াত করতেন তাঁরা সালাতে। আর তারকোনো সমস্যানেই যে তার পথচলায় কুরআনকে সঙ্গে রাখে। কুরআন তিলাওয়াত করে সে জীবনের সকল অনুষঙ্গে। শহীদ হওয়ার রাতে উসমান রাদিআল্লাহু আনহু আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত রত ছিলেন। এমনকি তাঁকে যে শহীদ করেছে- আল্লাহর কাছে তার যা প্রাপ্য সে তা-ই পাবে- সে বলেছে, তিনি যখন শহীদ হন তাঁর হাতে ধরা ছিল পবিত্র কুরআন।
সাহাবীদের পরে আমাদের পূর্বসূরী পুণ্যবান তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণও তাঁদের এ পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাঁরাও তাঁদের মতো তিলাওয়াতে ও কাজ-কর্মে কুরআনকেই পাথেয় হিসেবে ধারণ করেন। যেমন উসমান বিন আফফান রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমি হাম্মাদ বিন সালামার চেয়েও বড় আবেদ দেখেছি। কিন্তু তাঁর চেয়ে কল্যাণপথ যাত্রায়, কুরআনের তিলাওয়াতে এবং আল্লাহর জন্য আমলে বড় আর কাউকে দেখিনি। এদিকে আরেকজন বলেন, আমি আবু সুহাইল বিন যিয়াদ থেকে আর কাউকে তার উদ্যোগে এতোটা সক্রিয় দেখিনি। তিনি আমাদের প্রতিবেশি ছিলেন। সব সময় তিনি রাতের সালাতে এবং কুরআনের তিলাওয়াতে নিয়মিত ছিলেন। অধিক পড়ার কারণে কুরআন যেন তাঁর চাক্ষুস বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কুরআনের বিধি-বিধান পালনে, এ থেকে উপকৃত হওয়ার ফলেকুরআন যেন সর্বদা তাঁর চোখের সামনেই থাকত। ইমামু দারিল হিজরাহ মালেক বিন আনাস এর বিবরণ দিতে গিয়ে একজন বলেন, মালেক বিন আনাসের বোনকে জিজ্ঞেস করা হলো, মালেক বিন আনাস তাঁর গৃহে কী নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন?আর কী নিয়ে কাজ করতেন? তিনি বলেন, মাসহাফ শরীফ এবং তিলাওয়াত। এই হলো ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহর গৃহস্থব্যস্ততা। মাসহাফ ও তিলাওয়াত। এ বিষয়ে রয়েছে অনেকআছার। আরও বিস